লিখেছেন---ইলিয়াস হুসাইন
মানুষের কিছু বিষয় তার জন্মের পূর্বেই নির্ধারিত হয়ে যায়। আমার জন্য দারুল উলুমে আসা ছিল এমনই এক বিষয়। মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় আমার মার দাদা আমার ব্যাপারে এই দোয়া করে রেখেছিলেন। তবে আমি এ সম্পর্কে জানতে পারি যখন দারুল উলুম এ যাওয়ার স্থির সিদ্ধান্ত পরিবারকে জানাই। আমার মা এতদিন কেন এই দোয়া সম্পর্কে আমাকে জানাননি সেও এক বিস্ময়।
ছোটবেলা থেকেই দারুল উলুম দেওবন্দ ছিল আমার এক স্বপ্নময় নগরী। প্রথম যেদিন তারানায়ে দারুল উলুম শুনেছিলাম সেদিনের মুগ্ধতার রেশ আজও অনুভব করি। আমার তালিমি মুরুব্বী ছিলেন দারুল উলুমের সাচ্চা আশিক। দারুল উলুমের কোন ওস্তাদ সফরে এলে বড় হুজুর যেকোন মূল্যেই হোক তাঁকে আমাদের মাদ্রাসায় নিয়ে আসার চেষ্টা করতেন। হযরত মুহতামিম সাহেবক নিয়ে আসার জন্য হুজুরের দৌড়ঝাঁপ এবং অবশেষে ব্যর্থতার কান্না আমার হৃদয়ে এখনো বাজে।
জানিনা আমার নানার দোয়া না মাদ্রাসার এ পরিবেশ কীসে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তবে যখন দাওরার বছর সবাই প্রশ্ন করা শুরু করলো আগামী বছর কী করছো, তখন থেকেই মনে স্বপ্নের অঙ্কুরোদগম হয় যে আমি দারুল উলুমে যাবো।
অবশেষে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে রমজানের আট তারিখে যখন দেওবন্দের মাটিতে পা দিলাম তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না আমি দেওবন্দে আছি।
এসে উঠলাম মসজিদে আজিজের পাশে এক সাথী ভাইয়ের কামরায়। ইফতার শেষে দুজন সাথীকে নিয়ে যখন দারুল উলুমে প্রবেশ করলাম তখন আমার মনের যে পরিস্থিতি ছিল তা লিখে প্রকাশ করার মত নয়। দারুল উলুম এর বিশালতা দেখে আমি ছিলাম বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ। কাসেমী গেট পেরিয়ে যখন মূল লাল ভবনের সামনে এসে দাঁড়ালাম তখন আমার মুখ থেকে কথা সরছিল না। এই কি সেই স্বপ্নীল ভবন যা এতদিন কাগজের পাতায় দেখে এসেছি! এত সুন্দর! এত কারুকার্যময়!
সাথের দুই সাথি ছিলো পুরোনো। তাদের তাগাদায় দারুল উলুমের বুক চিরে হেঁটে এসে দাঁড়ালাম মসজিদে রশিদ এর সামনে। আমি যেন আমার দুচোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! কোন স্থাপনা এত সুন্দর হতে পারে!
সেদিন অন্ধকার রাতে মসজিদে রশিদ আমার হৃদয়পটে বিস্ময়ের যে ছাপ এঁকেছিল তার আবেশ এখনো অনুভব করি। এখনো আমি নানাভাবে বিভিন্ন জায়গা থেকে মসজিদে রশিদের ছবি তুলে এর সৌন্দর্যকে ধারণ করার চেষ্টা করি। কিন্তু প্রতিবারই অনুভব করি, ক্যামেরা এই স্নিগ্ধ কারুকার্যময় সৌন্দর্যের মহিমা ধারণ করতে ব্যর্থ।
সেদিন মসজিদে রশিদ এ তারাবি পড়ে কামরায় ফিরে এলাম। এরপর একসপ্তাহ যাবৎ আমি দারুল উলুম এর দিকে পা বাড়াইনি। কারণ সেদিন রাতের পর আমার মনে হচ্ছিল একা একা গেলে দারুল উলুমের বিশালতায় আমি পথ হারিয়ে ফেলবো। পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছি দারুল উলুমে এসে সবাই পথের দিশা পায়, কেউ পথ হারায় না।
শুরু থেকেই দারুল উলুমের প্রতিটি বিষয় ছিল আমার জন্য বিস্ময়ের। পরীক্ষার বিশাল হলরুমে হাজারো ছাত্রের মাঝে দুরুদুরু বুক নিয়ে বসেছিলাম। লেখার জন্য যে খাতা দেয়া হলো তাতে দেখলাম আমার নাম লেখা। আমি বিস্ময়ে হতবাক! এত ছাত্রের ভিড়ে আমার নাম লেখা খাতা আমার পর্যন্ত কিভাবে পৌঁছল! এও কি সম্ভব! পরে অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি অসাধারণ বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে অনেক অসম্ভবকেই দারুল উলুমের সুদক্ষ প্রশাসন সম্ভব করে তুলেছে।
বোর্ডিং থেকে খাবার উঠাতে গিয়ে দেখলাম কী অসাধারণ সুশৃংখল ব্যবস্থাপনা! কারো বঞ্চিত হওয়ার ভয় নেই। আমার দুবার তোলারও সুযোগ নেই। গোল গোল কিছু সীসার চাকতি দিয়ে খাবার তোলার পুরো বিষয়টিকে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে বিচক্ষণ প্রশাসন।
মাস শেষে জানলাম ছাত্রদের থেকে বেতন নেয়ার পরিবর্তে উল্টো মাদ্রাসার পক্ষ থেকে প্রত্যেককে ভাতা দেওয়া হয়। কী অদ্ভুত ব্যাপার! খাবার ফ্রি আবার মাস শেষে ভাতা! আমার বিস্ময় যেন কাটছেই না।
প্রথম যেদিন দরসগাহে প্রবেশ করি সেদিন ছিল আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন। দরসগাহ তো নয় এ যেন বিশাল প্রান্তরে আলোর ফোয়ারা। এই বিশালতা দেখে কোথায় বসবো এ নিয়ে আমি খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম।
অবশেষে দরস শুরু হল। একে একে আসাতিযায়ে কেরাম উপস্থিত হলেন। কিতাবের দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে আমি দুচোখ ভরে তাদেরকে দেখছিলাম। এই কি সেই আরশাদ মাদানী যার কথা আজীবন শুনে এসেছি? এই কি সেই যুগের ইবনে হাজার? মালিবাগে যার ইলমী বয়ান শুনে আমি রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম!
এই কি সেই হযরতুল ওস্তাদ আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপুরী, কাফিয়া থেকে আমি যার প্রেমে পরেছি?
এ যেন ছিল সুদূর নীলিমায় নক্ষত্র দেখে অভ্যস্ত এক বালকের আকাশভ্রমণ। সুদূরের দ্যুতিময় নক্ষত্রগুলো একদম কাছ থেকে দেখা।
প্রতিদিন আসাতিযায়ে কেরামের তাকরির শুনতাম আর মোবাইলে ও কাগজের বুকে তা ধারণ করার চেষ্টা করতাম। মনে হতো আমি এক স্বপ্নের জগতে আছি। এই বুঝি চোখ খুলে দেখবো কোথায় কী? আমিতো সেই আফতাবনগরে!
আসার সময় আমার এক অত্যন্ত মুশফিক ওস্তাদ হযরত মাওলানা আব্দুল্লাহ মারুফী সাহেব দামাত বারাকাতুহুমের কাছে একটি কিতাব ও চিঠি পাঠিয়েছিলেন। আমার দায়িত্ব ছিল সেগুলো পৌঁছে দেয়ার। উর্দু পারিনা মোটেও। তাই এক বড় ভাইকে সাথে নিয়ে গেলাম হুজুরের কাছে। হুজুরের সাথে সেই ছিল আমার প্রথম সাক্ষাৎ। এরপর যতবার গিয়েছি ততবার'ই হুজুরের সরল ব্যবহার ও অপত্য স্নেহ আমাকে বিস্মিত করেছে। কখনো দরসগাহে কখনো বাসায় গিয়ে হুজুরকে বিরক্ত করেছি। কিন্তু স্নেহময় হাসিমাখা মুখ কখনো মলিন হতে দেখিনি।
দারুল উলুমের প্রতিটি ভবন আমাকে সেই শুরু থেকেই অভিভূত করে। বিশেষভাবে আমার বাসস্থান বাবুজ জাহের। এ যেন দারুল উলুমের সমুদ্রতম বিশালতায় এমন এক ছোট্ট দ্বীপ যাতে কেবল বাঙ্গালীদের অধিকার। এ ভবনের অদ্ভুত কামরাগুলো আমি আজও গুনে শেষ করতে পারিনি।
বছরের শুরু থেকেই দারুল উলুমকে ধারণ করার চেষ্টা করছি। কখনো মোবাইলের ক্যামেরায়, কখনো কাগজের পাতায়, আর কখনো হৃদয়ের ক্যানভাসে। আমি জানি এক্ষেত্রে আমি সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তবু এখনো চেষ্টা করছি।
মোবাইলের ছবিগুলো হয়ত হারিয়ে যাবে। কোন একদিন কাগজের পাতা থেকেও মুছে যাবে দারুল উলুমের সব স্মৃতি। কিন্তু বুকের গহীনে লালন করা স্বপ্নীল দারুল উলুম টিকে থাকবে আজীবন!
No comments:
Post a Comment